বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার হাতে মোবাইল সিম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ জানতে চাওয়া হয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণ পাওয়া গেলে শিগগিরই রোহিঙ্গাদের হাতে অন্তত ৫টি করে বাংলাদেশি মোবাইল সিম দেয়া হতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বিষয়টি দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এমনিতেই রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশি সিম ব্যবহার করে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সহায়তা নিয়ে এদেশ থেকে মিয়ানমারে টাকা পাচার করছে। কারণ মিয়ানমার সীমান্তের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশি মোবাইল সিম সচল থাকে। এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি মোবাইল সিম দেয়া হবে কিনা, বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে।
এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
যাচাই-বাছাই শেষে যে সুপারিশ আসবে, সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতি নেই জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সিম চালুর জন্য প্রয়োজন হয় জাতীয় পরিচয়পত্র। এটা না থাকার পরও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশের মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। কয়েক লাখ সিম ব্যবহার করছে রোহিঙ্গারা। এ ছাড়া দেশীয় একাধিক মোবাইল ফোন অপারেটরের বিরুদ্ধে ক্যাম্প এলাকায় সিম বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। দেশীয় মোবাইল সিমের পাশাপাশি মিয়ানমারের মোবাইল সিমও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দেদারছে ব্যবহার হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, সিম দেয়ার আগে অনেকগুলো বিষয় আমাদের ভেবে দেখতে হবে। কারণ, আমরা নিবন্ধন ছাড়া সিম চালু করবো না। তাহলে তাদের সিম কীভাবে নিবন্ধন হবে, সেই বিষয়টি ভাবতে হবে। কতগুলো সিম দেয়া যাবে, কারা সিম পাবে, কত বছর বয়স হলে সিম কিনতে পারবে, ব্যক্তিগতভাবে নাকি পারিবারিকভাবে দেয়া হবে, সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
তারপর রোহিঙ্গাদের সিম দেয়ার বিষয়টি আসবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকরা বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক ব্যবহারের পাশাপাশি মিয়ানমারের এমটিএমসি’র টেলিকম নেটওয়ার্কও ব্যবহার করে আসছে। এটা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক। আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে মাঝে-মধ্যে বিটিআরসি’র কিছু কর্মকর্তাকে পরিদর্শনে পাঠানো হয়। বাস্তবে এখন পর্যন্ত কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৫ সালে সরকার দেশে যখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করে তখন সেই নীতিমালায় বলা হয় বাংলাদেশের কোন বৈধ নাগরিক যার বয়স ১৮ বছর সেই ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র বা তার পাসপোর্ট দিয়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করতে পারবে। অথচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকরা আমাদের দেশের নাগরিকদের নামে ব্যবহৃত সিম অবৈধভাবে ব্যবহারের পাশাপাশি মিয়ানমারের টেলিকম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে মিয়ানমারে টেলিকম প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও ব্যবসা পরিচালনা করছে।
টেলিকম সেবা ও মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা মিয়ানমারে চলে গেছে। কার্যত বর্তমান টেলিযোগমন্ত্রী এবং বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার দায়ভার ঘোচাতে তারা রোহিঙ্গা নাগরিকদের বৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাঁচটি করে সিম দেয়ার পাঁয়তারা তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে হয়তো অপারেটরদের মোটা দাগে কিছু ব্যবসা পরিচালনা হবে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা, সন্ত্রাস মাদক ও এইডস-এর মতো মহামারি ব্যাপকতা সৃষ্টি করতে পারে। এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য আমার মতামত হচ্ছে সবার আগে অবৈধ নেটওয়ার্ক বন্ধ ও সকল অবৈধ সিম জব্দ করা। দ্বিতীয়ত- রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে বসে স্থানীয় প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রেক্ষিতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গারা অবৈধ নেটওয়ার্ক সিম ব্যবহার করে মাদক পাচার, অর্থ পাচার, চোরাচালান এবং অসামাজিক কার্যে লিপ্ত হয়ে হাজারের মতো এইড্স রোগী আজ শুধু কক্সবাজার জেলা নয়, সারা বাংলাদেশের জন্য আতঙ্ক তৈরি করেছে?। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মানবতার আড়ালে ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দেয়ার যে পাঁয়তারা তা আমরা বুঝি। কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের বৈধভাবে পাঁচটি করে সিম দেয়া যাবে না।
২০১৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ৭ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এলাকাগুলোয় মোবাইল ফোনের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে মোবাইল অপারেটরদের কাছে নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সে সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় কিছুদিন নেটওয়ার্ক সীমিত ছিল। পরবর্তী সময়ে তা আবার স্বাভাবিক করে দেয় সরকার। এদিকে বুধবার প্রেস ক্লাবের সামনে রোহিঙ্গাদের সহজ শর্তে ও সুলভ মূল্যে মোবাইল সিম দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জাতীয় সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমরা যারা স্থানীয় অধিবাসী তারা এখন মহা বিপদে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক এবং বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে, এমনিতেই তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ তাদের বর্তমানে ব্যবহৃত সকল সিম জব্দ না করে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তারা বলছে বৈধভাবে দিলে অবৈধ ব্যবহার বন্ধ হবে এটা হাস্যকর কথা। সরকারের উচিত হবে তাদেরকে অবৈধ সকল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া। তা না করে নতুন করে বৈধ ভাবে সিম দিয়ে সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতীমূলক। আমরা এ সিদ্ধান্ত মানি না।
সুত্র: মানবজমিন
পাঠকের মতামত